একটি ঝড়ের রাত
বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষ বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখােমুখি হয়। এসব অভিজ্ঞতার কোনােটি আনন্দদায়ক, কোনােটি রােমাঞ্চকর আবার কোনােটি প্রচণ্ড ভয়ের। যে ঘটনাগুলাে মনকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়, আহত করে বা ভীতিবিহ্বল করে, মানুষ তা সহজে ভােলে না। একটি ঝড়ের রাত তেমনই আমার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। আমি যখনই সে-রাতের কথা ভাবি, ভয়ে শিউরে উঠি। অন্ধকার রাত, ঝােড়াে বাতাসের গর্জন, সঙ্গে মুষলধারায় বৃষ্টি, হুড়মুড় করে চালা ঘরগুলাের ভেঙে পড়ার শব্দ, ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ - সবকিছু আমার মনে ছবির মতাে ভেসে ওঠে।
সকাল থেকেই ঈশান কোণে মেঘ জমছিল। কালাে কালাে পুঞ্জীভূত মেঘে দুপুরের পরই দিনের আলাে হারিয়ে গেল। বাতাসও যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। বেতার ও টেলিভিশনে বারবার বিপদ সংকেত জানানাে হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা সবাইকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছে। তা শুনে মানুষও দলে দলে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছে। আমাদের পাকা দেয়ালে টিনের চালার বাড়ি। তাই বাবা বললেন, এখানে আমরা নিরাপদে থাকবাে।
সন্ধ্যা হতে হতে প্রকৃতি এক অপরিচিত রূপ নিয়ে আবির্ভূত হলাে। রাখালেরা গরুর পাল নিয়ে আগেভাগেই বাড়ি ফেরে। মাঝিরা নিরাপদ স্থানে নৌকা বাঁধে। নদীর ধারে দেখা গেল বেশ কয়েকজন নারী চরম উল্কণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে অস্পষ্টপ্রায় জেলে-নৌকাগুলাের দিকে। প্রিয়জনের জন্য কাতর অপেক্ষা, পাখিদের ব্যস্ত হয়ে নীড়ে ফেরা, হাটুরেদের আতঙ্কিত পদক্ষেপ, থেকে থেকে গবাদি পশুর আর্তনাদ যেন আসন্ন বিপদের আভাস দিচ্ছিল। অল্পক্ষণেই অন্ধকারের চাদরে চারপাশটা ঢেকে গেল। বিদ্যুৎ চমকে আঙিনা থেকে দিগন্ত পর্যন্ত যেটুকু চোখে পড়ে, তার সবটাই আমার কাছে ভূতুড়ে লাগছিল।
সন্ধ্যার পর থেকে বাতাসের বেগ বাড়তে লাগলাে। তা ঝড়াে বৃষ্টিতে রূপ নিতে সময় নিল না। দানবীয় শক্তি নিয়ে ঝড় আছড়ে পড়ল আমাদের লােকালয়ে। আমি ভয়ে জড়ােসড়াে হয়ে বাবা-মার গা-ঘেঁষে বসে আছি। হারিকেনের আবছা আলােয় পরিবেশটা আরাে থমথমে। এর মধ্যে ঝড়ােবৃষ্টির একটানা শব্দে কানে তালা লাগার মতাে অবস্থা। বাবা বললেন, শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চাল জায়গায় জায়গায় ছিদ্র হয়ে বৃষ্টির পানি পড়তে আরম্ভ হলাে। মনে হলাে যে-কোনাে সময়ে পুরাে চালাটি আমাদের মাথার উপরে খসে পড়বে। বাবা আমাদের নিয়ে একটি মজবুত খাটের নিচে অবস্থান নিলেন। কিছুক্ষণ পরেই পায়ের নিচে পানির প্রবাহ টের পেলাম। বুঝলাম দরজার নিচ দিয়ে ঘরে একটু একটু করে পানি ঢুকছে। তখনও পর্যন্ত বাবা খাটের নিচে থাকা নিরাপদ মনে করলেন। পাশের বাড়ি থেকে নারী-পুরুষের আর্তচিঙ্কার শােনা যাচ্ছিল। বাবা চিৎকার করে তাদেরকে আমাদের ঘরে আসতে বললেন। কিছুক্ষণ পরেই বিকট শব্দে কিছু একটা আছড়ে পড়লাে বাড়ির একপাশে। বাতাসের প্রবল তােড়ে উড়ে গেল পিছনের বারান্দার চাল।
অল্পক্ষণ পরে প্রতিবেশীদের কয়েকজন কাকভেজা হয়ে হুড়মুড় করে আমাদের ঘরে ঢুকল। তাদের একজনের মাথায় আঘাত লেগেছে। বাবা দেরি না করে কী একটা ওষুধ মেখে লােকটির মাথা গামছা দিয়ে বেঁধে দিলেন। তাকে ধরে একটি নিরাপদ জায়গায় বসালেন। শুনলাম একটা প্রকাণ্ড শিমুল গাছ উপড়ে গিয়ে তাদের ঘরের উপর পড়েছে। তারাই বললাে, আমাদের গােয়ালঘরের চাল নাকি উড়ে গিয়েছে। গরুগুলাের কথা ভেবে। আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেল।
এক সময়ে বতািসের বেগ খানিকটা কমে আসে। তখনও থেকে থেকে ভয়ানক শব্দে বাজ পড়ছে। বাবা-মা আমাকে শুকনাে কাপড় বের করে দিলেন। প্রতিবেশীদের জন্যও কাপড়, কিছু শুকনাে খাবার ও পানির ব্যবস্থা করে তাদেরকে মােটামুটি স্বাভাবিক করলেন। বাবা আহত লােকটিকে বারবার পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সে আগের চেয়ে ভালাে বােধ করছে। আরাে কিছুক্ষণ পর ঝড় পুরােপুরি থেমে গেল। তবে সমস্ত রাতই আমরা বসে কাটালাম।
দিনের আলাে ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বাবা দরজা-জানালা খুলে দিলেন। আমি বাইরে বেরিয়ে যা দেখলাম, এক কথায় তা অবিশ্বাস্য। বেশ কয়েকটি বড়াে গাছ উপড়ে পড়েছে। এখানে-সেখানে মৃত ও আহত পাখি পড়ে আছে। আমাদের ঘরের দুটি বারান্দার চাল উড়ে গেছে। অন্য একটি বাড়ির ঘরের চাল উড়ে এসে পড়েছে আমাদের উঠানে। গােয়ালঘরে ছুটে গিয়ে দেখি, এর চালা নেই - একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষ আছড়ে পড়েছে সেখানে। আমাদের চারটি গরুর একটি বড়াে রকমের আঘাত পেয়েছে। কয়েক বাড়ি পরে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গিয়ে দেখি, বেশ কয়েকজন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। একজনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, তাতে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানােই কঠিন ব্যাপার। বাবা এবং আরাে কয়েকজন যুবক মিলে একটি মাচা বানিয়ে লােকটিকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটলেন। আমি মাকে সাহায্য করতে গেলাম। মনে মনে বন্ধুদের কথা ভাবছি আর অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠছি।
সেদিনের রাতে ঝড়ের যে দানবীয় তাণ্ডব দেখলাম, তা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। ঝড় যেন তার প্রকাণ্ড গ্রাসে সবকিছু নিঃশেষ করতেই এসেছিল। ঘর, আঙিনা, বনবাদাড়, নদীর বাঁধ, মেঠো ও পাকা পথ – সর্বত্রই ধ্বংসলীলার ক্ষত। ওই রাতের পরে গ্রামবাসীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। আর মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল আরাে বেশি।